ডিএম‌এফ চিকিৎসকদের প্রেসক্রাইব করার বৈধতা আছে কি? আইন কি বলে?

    ডিএম‌এফ কি?

    "ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টি" ডিপ্লোমাকে সংক্ষেপে ডিএম‌এফ বলা হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের অধীনে (৪ বছর একাডেমিক+৬ মাস ইন্টার্নশিপ সহ) সাড়ে ৪ বছর মেয়াদি এই মেডিকেল ডিপ্লোমা কোর্সে ১০ এর অধিক মেডিকেল সাবজেক্ট পড়ানো হয়। [তথ্যসূত্র দেখুন

    তাদের ক্যারিকুলামে থাকা সাবজেক্টে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে

    • ১. মেডিকেল বেসিকস: অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, প্যাথলজি, এবং ফার্মাকোলজি।
    • ২. ক্লিনিক্যাল স্কিলস: রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং রোগী পরিচালনা।
    • ৩. চিকিৎসা সেবা: মেডিসিন ও পেডিয়াট্রিকস, গাইনী ও অবস, সার্জারি, ইনডোর ও আউটডোর পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি।
    • ৪. কমিউনিটি স্বাস্থ্য: জনস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদান।
    • ৫. এপিডেমিওলজি: রোগের প্রাদুর্ভাব ও প্রভাবের গবেষণা।
    • ৬.পরিবার পরিকল্পনা: জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং প্রজনন স্বাস্থ্য।
    • ৭. সাধারণ সার্জারি: মাইনর সার্জারি, ওটি এ্যাসিস্ট, জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসা পদ্ধতি।
    • ৮. নার্সিং ও মিডওয়াইফ স্কিলস: রোগী যত্ন এবং নৈতিকতা, গর্ভবস্থায় সেবা, প্রসূতি সেবা, ডেলিভারি ইত্যাদি।
    • ৯. প্রাথমিক চিকিৎসা: মেডিকেল ইমার্জেন্সি শনাক্তকরণ, জরুরি চিকিৎসা, লাইভ সেভিং, সিপিআর, ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি।
    • ১০. স্বাস্থ্য শিক্ষা: স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং শিক্ষা প্রচার।

    এই কোর্সের মাধ্যমে ছাত্ররা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকরী দক্ষতা অর্জন করে এবং কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে সক্ষম হন।

    বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন-২০১০ এর ৬১ নং আইন অনুযায়ী এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় নিবন্ধন যোগ্য একমাত্র মেডিকেল ডিপ্লোমা ডি.এম‌.এফ। 

    বিএমডিসি পঞ্চম তফসিল অধিভুক্ত এই ডিপ্লোমা হোল্ডাররা কাউন্সিল থেকে "ডি ক্যাটাগরি" মেডিকেল এ্যাসিসটেন্ট পেশাদার হিসেবে রেজিস্ট্রেশন পেয়ে থাকেন। বিএমডিসির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে তাদের রেজিস্ট্রেশন সার্চ করলে এমবিবিএস, বিডিএস দের ন্যায় তাদের রেজিস্ট্রেশনের বৈধতা যাচাই করা যায়।[তথ্যসূত্র দেখুন ] এই ডিপ্লোমা ধারীরা উক্ত আইন অনুযায়ী ৭১ ধরণের মেডিসিন প্রেসক্রাইব করতে পারেন। [তথ্যসূত্র দেখুন] এছাড়াও মেডিসিন, মাইনর সার্জারি এবং মিড‌ওয়াইফ পেশায় বৈধভাবে নিয়োজিত থাকতে পারেন। সরকারীভাবে তারা উপজেলা এবং ইউনিয়ন হেলথ কমপ্লেক্স "উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার" পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে তাদের পরিধি অনুযায়ী চিকিৎসা ও সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। [তথ্যসূত্র দেখুন]

    প্রতিযোগিতা মূলক ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেয়ে সরকারি ১১ টি ম্যাটস এবং ভর্তি পরীক্ষায় পাশ মার্ক পেয়ে বিভিন্ন বেসরকারি ম্যাটসে ভর্তি হবার পর ১০+ মেডিকেল সাবজেক্টের প্রতিটিতে ২০০ মার্কের পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে ৪ বছর একাডেমিক পড়াশোনা করতে হয়। তারপর তারা জেলা সদর হাসপাতালে ৬ মাস ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ থেকে "ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টি" ডিগ্রি প্রাপ্ত হন। ইংলিশ মিডিয়াম এই ডিপ্লোমা কোর্সের একাডেমিক পড়াশোনার সময় তাদেরকে এমবিবিএসদের ব‌ই থেকেই পড়ানো হয় তবে এমবিবিএসদের থেকে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস এবং ক্যারিকুলামে। কেননা ডিএম‌এফ একটি ডিপ্লোমা কোর্স এবং এমবিবিএস একটি গ্রাজুয়েশন কোর্স।

    ডিএম‌এফ প্রেসক্রাইব করতে পারে কি?

    হ্যাঁ পারে। বিএমডিসির আইন অনুযায়ী ডিএম‌এফ কোর্স চালু হবার পর থেকেই সেই ১৯৮০ সাল থেকে তারা ৭৩ ধরনের মেডিসিন প্রেসক্রাইব করতে পারে। সেই সাথে মাইনর সার্জারি এবং মিড‌ওয়াইফ পেশা প্র্যাকটিস করার বৈধতা দেয়া হয়েছে যা তাদেরকে বিএমডিসি কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেটে সহ বিএমডিসির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা আছে। এখানে দেখুন

    পৃথিবীব্যাপী এমবিবিএস ছাড়াও যে মেডিকেল পেশাজীবীরা প্রেসক্রিপশন করার ক্ষমতা রাখেন

    স্বাস্থ্যখাতে ডিএমএফ চিকিৎসকদের ভূমিকা কি?

    ১. উন্নত রেফারেল সিস্টেম 

    যেসকল রোগীর জন্য গ্রাজুয়েট এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা প্রয়োজন তা বাছাই করে রেফারেল সিস্টেমে গ্রাজুয়েট চিকিৎসকের নিকট প্রেরণ করার এ কাজটি দ্রুততার সাথে করতে সক্ষম ডিএম‌এফ ডিগ্রিধারীরা। 

    ২. এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধ 

    ডিএম‌এফ দের কোর্স ক্যারিকুলাম অনুযায়ী তাদেরকে ১ বছর ফার্মাকোলজি এবং প্যাথলজি সাবজেক্ট পড়ানো হয়। এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সহ ফার্মাকোলজি, প্যাথলজির‌ ব্যাসিক সকল কিছুই তাদের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। তাই এন্টিবায়োটিকের যত্রতত্র ব্যাবহার, রেজিস্ট্যান্স রোধে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যাতিত ইচ্ছেমতো মেডিসিন সেবনের ঝুঁকির ব্যাপারে রোগীদের সতর্ক এবং কাউন্সিলিং করার জন্য এই ডিএম‌এফ ডিগ্রিধারীরা একটি চমৎকার একটি সমাধান। কেননা যেসকল প্রত্যন্ত অঞ্চল এখনো গ্রাজুয়েট চিকিৎসকের আ‌ওতার বাইরে, সেসব অঞ্চলেও এই ডিপ্লোমাধারীরা যতেষ্ট বড়সড় প্রভাব বিস্তার করে আছে। কিন্তু নিয়োগের অভাবে এই ডিপ্লোমাধারীদের সেভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

    ৩. মানসম্মত উপযুক্ত প্রাথমিক চিকিৎসা

    চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সের তাদের যে সিলেবাস কাভার করানো হয়, তা প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা সুনিশ্চিত করার জন্য শুধু যথেষ্ট‌ই নয়, বরং তার থেকেও বেশি। তাই তাদের ৭৩টা ঔষধ লেখার বৈধতা এবং চিকিৎসা জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দ্রুততর সময়ে মানসম্মত প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

    ৪. স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতা

    ডিএম‌এফ ডিগ্রিধারী উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের নিয়োগ দেয়া হয় উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে। একদম গ্রাম থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরামর্শ দেয়া তাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

    ৫. প্রতিষেধক কার্যক্রম

    ভ্যাকসিনেশন ও অন্যান্য প্রতিষেধক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা।

    ৬. জরুরি চিকিৎসা প্রদান

    গ্রাজুয়েট চিকিৎসক যে অঞ্চলে অপ্রতুল সেখানে জরুরী প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে দ্রুততর সময়ের মধ্যে বিশেষায়িত সেবা কেন্দ্রে প্রেরণ করা। 

    ৭. প্রসূতি সেবা প্রদান

    গাইনী এবং অবস সাবজেক্ট তাদের ক্যারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত এবং ইন্টার্নশিপেও রয়েছে হাতে কলমে ট্রেনিং তাই প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের প্রাথমিক নারী স্বাস্থ্য সেবা প্রদান এবং প্রসবপূর্ব ও প্রসবপরবর্তী মানসম্মত সেবা প্রদানে তাদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

    ৮. স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারা প্রচার

    খাদ্যাভ্যাস, স্বচ্ছতা, পরিবার পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা। 

    ৯. স্বাস্থ্য তথ্য সংগ্রহ ও রিপোর্টিং

    স্বাস্থ্য তথ্য সংগ্রহ ও সরকারী স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে নিয়মিত রিপোর্ট প্রদান করা। 

    ১০. স্বাস্থ্য কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা

    স্থানীয় কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম সুসমন্বিত রাখা এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহ নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

    এসএসি‌এমও-রা সাধারণত সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্পের আওতায় কাজ করেন এবং তাদের কাজ এলাকার জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

    অপরদিকে, 

    ৩ মাস, ৬ মাস, ১ বছর মেয়াদি বিভিন্ন ভুয়া কোর্সধারী অনেকেই চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। যাদের কাছে রোগীরা গিয়ে অপচিকিৎসার শিকার হয়। তাদের পর্যাপ্ত রেফারেল নলেজ না থাকা এবং মেডিকেল জ্ঞান স্বল্পতার কারণে রোগীদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। তাদের যত্রতত্র এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে ঔষধগুলো অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। কিছু অর্থলোভী কুচক্রী মহল এই সংক্ষিপ্ত অনুমোদনহীন কোর্সগুলো চালাচ্ছেন। স্বার্থান্বেষী মহলের ছত্রছায়ায় ভূয়া চিকিৎসক ঠিকই অপচিকিৎসা চালিয়ে আইনের হাত থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে।

    মেডিকেল চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমাধারীদের বাদ রেখে এইচএসসি পাশ করা জেনারেল শিক্ষিতকে ৬ মাস মেয়াদি ট্রেনিং করিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে ঔষধ লেখার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। যা খুবই দুঃখজনক।

    এমবিবিএস ডাক্তার থাকতে ডিএম‌এফ চিকিৎসকের কি প্রয়োজন?