বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কে দায়ী, দায়িত্ব কার
একটি সময় ছিল যখন সংক্রমণজনিত রোগগুলোর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক ছিল আমাদের প্রধান অস্ত্র। তবে এখন সেই অস্ত্র ক্রমশ ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা এক নীরব মহামারীতে রূপ নিয়েছে। এটি শুধু একটি স্বাস্থ্যগত সংকট নয়, বরং এটি জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর সরাসরি হুমকি।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স (Antibiotic Resistance) বর্তমান বিশ্বে এক ভয়াবহ স্বাস্থ্য সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) একে "সাইলেন্ট প্যানডেমিক" হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। বাংলাদেশেও এটি একটি মারাত্মক সমস্যা, যেখানে সংক্রমণ নিরাময়ে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের অভাব দেখা দিচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ডিপ্লোমা ইন মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি (DMF) কোর্স করা চিকিৎসকদের অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের জন্য দায়ী করা হয়। কিন্তু এটি একচ্ছত্রভাবে শুধু DMF পাস চিকিৎসকদের ওপর দোষ চাপানোর মতো সরলীকৃত ধারণা। কারণ, বাংলাদেশে চিকিৎসক, রোগী, ফার্মাসিস্ট, কৃষি খাত, সরকারি নীতিনির্ধারণী সংস্থা, এমনকি সাধারণ জনগণ— সবাই কমবেশি অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সবচেয়ে বেশি।২০১৯ সালে প্রকাশিত The Lancet Infectious Diseases-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে সংক্রমণের কারণে মৃত্যু হওয়া রোগীদের মধ্যে ৭০% রোগী রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন।
ICDDR,B-এর একটি গবেষণা অনুযায়ী, শিশুদের ডায়রিয়াজনিত সংক্রমণে ব্যবহৃত ওষুধগুলোর ৬০%-এর বেশি এখন আর কার্যকর নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৮০% রোগী কোনো না কোনোভাবে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে, যার অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয় বা ভুলভাবে ব্যবহৃত হয়।
এন্টিবায়োটিক রেজিসট্যান্স চিকিৎসকদের ভূমিকা
(ক) অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ও ভুল ব্যবহার
MBBS, BCMCH, DMF—সব ধরনের চিকিৎসকদের মধ্যেই অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে।
অনেক চিকিৎসক সামান্য সংক্রমণেও অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেন, যা ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করে।
পর্যাপ্ত ল্যাব টেস্ট ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করা একটি বড় সমস্যা।
(খ) ভুল ডোজ ও সময়কাল নির্ধারণ
রোগীদের উপযুক্ত কোর্স সম্পূর্ণ করতে বলা হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই তারা তা অনুসরণ করেন না।
চিকিৎসকরাও কখনও কখনও ভুল ডোজ বা কম সময়ের জন্য ওষুধ নির্ধারণ করেন, যা রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধির জন্য সহায়ক।
তবে, শুধুমাত্র DMF পাস চিকিৎসকদের ওপর এই দায় চাপানো অনুচিত।
DMF চিকিৎসকরা মূলত গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসা সেবা দেন, যেখানে অধিকাংশ রোগী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সুযোগ পান না।
রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ নিশ্চিত করতে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, এবং ভুল ব্যবহারের জন্য শুধুমাত্র তাদের দায়ী করা ভুল।
ফার্মাসিস্ট ও ওষুধ বিক্রেতাদের ভূমিকা
WHO-এর মতে, বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত বিক্রির হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশে ৮০%-এর বেশি ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি হয়।
(ক) প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি
বাংলাদেশে ফার্মেসিগুলোতে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই সহজেই অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায়।
অনেক ফার্মেসির মালিক চিকিৎসক নন, অথচ তারা রোগীর উপসর্গ শুনে অ্যান্টিবায়োটিক সরবরাহ করেন, যা একটি বড় সমস্যা।
(খ) ভুল পরামর্শ ও ডোজ
ফার্মেসির কর্মচারীদের অনেকেরই যথাযথ মেডিক্যাল শিক্ষা নেই, ফলে তারা ভুল পরামর্শ দেন।
রোগীরা পরিপূর্ণ কোর্স শেষ না করেই অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ করে দেন, যা প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরির অন্যতম কারণ।
রোগীদের ভূমিকা
ICDDR,B-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০% রোগী অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স অসম্পূর্ণ রেখে দেন, যা রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি করে।
(ক) নিজে নিজে ওষুধ সেবন
বাংলাদেশে অনেক মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করেন।
পুরনো প্রেসক্রিপশন দেখে বা অন্যের পরামর্শে ওষুধ গ্রহণ করা রেজিস্ট্যান্সের একটি বড় কারণ।
(খ) কোর্স শেষ না করা
অনেক রোগী অ্যান্টিবায়োটিক কয়েকদিন খাওয়ার পরেই বন্ধ করে দেন, যা ব্যাকটেরিয়াকে শক্তিশালী করে তোলে।
কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাতের ভূমিকা
(ক) মুরগি ও গবাদি পশুর খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার
বাংলাদেশে পোল্ট্রি ও গবাদিপশু খাতে দ্রুত ওজন বৃদ্ধির জন্য ব্যাপকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।
এটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।
(খ) অ্যান্টিবায়োটিকযুক্ত খাদ্যের প্রভাব
অ্যান্টিবায়োটিক যুক্ত মাছ, মাংস, ও দুগ্ধজাত পণ্য খাওয়ার ফলে মানুষের শরীরে প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া ঢুকে পড়ছে।
সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও নীতিমালার দুর্বলতা
(ক) আইন প্রয়োগের অভাব
১৯৮২ সালের ‘ড্রাগ কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স’ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক শুধুমাত্র নিবন্ধিত চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনের ভিত্তিতে বিক্রয়যোগ্য। কিন্তু বাস্তবে এটি কার্যকর হচ্ছে না।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর (DGDA) ও ফার্মেসিগুলোতে পর্যাপ্ত নজরদারি নেই।
(খ) গবেষণা ও তথ্যের অভাব
দেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা নেই।
ব্যাকটেরিয়ার রেজিস্ট্যান্স প্যাটার্ন বোঝার জন্য অত্যাধুনিক ল্যাব ও গবেষণার প্রয়োজন।
পরিবেশগত কারণ ও দূষণ
(ক) হাসপাতালের বর্জ্য ও অ্যান্টিবায়োটিক দূষণ
হাসপাতাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির বর্জ্য থেকে জলাশয়ে বিপজ্জনক মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশ করছে।
সমাধান ও করণীয়
১. চিকিৎসকদের দায়িত্ব
MBBS, BCMCH, DMF—সব চিকিৎসককে WHO-এর গাইডলাইন মেনে চলতে হবে।
পর্যাপ্ত ল্যাব টেস্ট ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করা উচিত নয়।
২. ফার্মাসিস্ট ও ওষুধ বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণ
প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
ওষুধ বিক্রেতাদের জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা জরুরি।
৩. জনসচেতনতা বৃদ্ধি
গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৪. কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাতে নিয়ন্ত্রণ
অ্যান্টিবায়োটিকবিহীন বিকল্প খাদ্য ও চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসন্ধান করতে হবে।
৫. সরকারি পর্যায়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ
অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধির জন্য শুধুমাত্র DMF চিকিৎসকদের দোষারোপ করা ভিত্তিহীন ও বৈজ্ঞানিকভাবে অযৌক্তিক। কারণ, এটি একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যেখানে চিকিৎসক, রোগী, ফার্মাসিস্ট, কৃষি খাত, ও সরকার—সবাই দায়ী। সচেতনতা বৃদ্ধি, কঠোর আইন প্রণয়ন এবং গবেষণার ওপর জোর দিলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। নইলে, ভবিষ্যতে সাধারণ সংক্রমণেও কার্যকর ওষুধের অভাবে স্বাস্থ্যখাত বড় ধরনের সংকটে পড়তে পারে।
Post a Comment