ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের এল.এম.এফ ডাক্তারের বর্তমান রূপ ডি.এম.এফ ডাক্তার

    lmf, dmf, mats, scamo history

    চিকিৎসক ও ডাক্তার এ দু'টি শব্দই বিশেষ্য পদ। সেইসাথে সমার্থক শব্দ। স্থান-কাল-পাত্রভেদে চিকিৎসক ও ডাক্তার শব্দটি বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়। বাংলা ভাষাভাষীর লোক চিকিৎসকদের 'ডাক্তার' বলে সম্বোধন করেন।

    আধুনিক এলোপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি দিক থেকেই আজকের এই বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ছিল ব্রিটিশ সরকারের উপনিবেশ। যা এশিয়া উপমহাদেশ নামে পরিচিত ছিল। এই উপমহাদেশটি তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথমত; ভারত অনেকগুলো অঙ্গরাজ্যের সমন্বয়ে। দ্বিতীয়ত; বেঙ্গল প্রদেশের কিছু অংশ নিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ। তৃতীয়ত; পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশ সমূহ বর্তমানে পাকিস্তান। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এ উপমহাদেশ এলোপ্যাথিক চিকিৎসা বিদ্যায় তেমন কোনো উন্নতি সাধন করতে পারেনি। যার কারণে ব্রিটিশরা মর্ডাণ চিকিৎসা বিদ্যার উন্নতির জন্য এই উপমহাদেশটির কিছু অঙ্গরাজ্য সমূহে ‘স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টি- রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ’ তৈরি করে বিভিন্ন ‘মেডিকেল স্কুল’ সমূহের মাধ্যমে চিকিৎসা বিদ্যায় লাইসেন্সশিয়েট অব মেডিকেল ফ্যাকাল্টি (এল.এম.এফ) কোর্স মেম্বার অব মেডিকেল ফ্যাকাল্টি (এম.এম.এফ) কোর্স, লাইসেন্সশিয়েট মেডিকেল প্র্যাকটিশনার (এল.এম.পি) কোর্স, হসপিটাল এ্যাসিসট্যান্ট (এইচ.এ) কোর্স প্রভৃতি পরিচালনা করেছিলেন। যাতে করে এই উপমহাদেশে মধ্যম মানের এলোপ্যাথিক চিকিৎসক তৈরি করা সহজতর হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বককালে পূর্ব বঙ্গে মোট ৬ টি মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমত ১৮৭৫ সালে ঢাকা মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় মিডফোর্ড হাসপাতাল অন্তর্ভূক্ত করে (যা বর্তমানে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ)। তারপর ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও সিলেট মেডিকেল স্কুল। ১৯২৫ সালে আরেক টি মেডিকেল স্কুল ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ মেট্রিকুলেশন/ মেট্রিক পাস করার পর এসকল মেডিকেল স্কুল সমূহে ৪ বছর মেয়াদী এল.এম.এফ কোর্স করা যেত। এছাড়াও তৎকালীন (১৮২২-১৯৬০ সাল) সময়ে ভারত, নেপাল ও পশ্চিম পাকিস্তানে আরো কিছু মধ্যম মানের ডাক্তারি কোর্স যেমন; লাইসেন্সশিয়েট অব মেডিসিন এন্ড সার্জারি- এল.এম.এস; ডিপ্লোমা ইন মেডিসিন এন্ড সার্জারি- ডি.এম.এস; ডিপ্লোমা ইন মর্ডাণ মেডিসিন এন্ড সার্জারী- ডিএমএমএস; ডিপ্লোমা অব মেডিকেল প্র্যাকটিশনার- ডি.এম.পি; লাইসেন্সশিয়েট- এল.এস.এম.এফ; মেম্বারশিয়েট- এম.এস.এম.এফ চালু ছিল। রেফারেন্স; বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল এ্যাক্ট-১৯৭৩; ১৯৮০; ইন্ডিয়া মেডিকেল কাউন্সিল এ্যাক্ট-১৯৫৬; পাকিস্তান মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল এ্যাক্ট, দি বেঙ্গল মেডিকেল এ্যাক্ট ১৯১৪ ইত্যাদি।

    ব্রিটিশদের সৃষ্ট স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টি সমূহ হল স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টি অব বেঙ্গল, স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল, স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টি অব বোম্বে, স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টি অব উত্তর প্রদেশ, স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টি অব গুজরাট, স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টি অব মহারাষ্ট্র, স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টি অব পাঞ্জাব ইত্যাদি। এরই ফলস্রুতিতে ১৯১৪ সালে তৈরি হয় দি স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টি অব বেঙ্গল এবং ১৯৪৭ সালে তা রূপান্তরিত হয়, দি স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টি অব ইষ্ট পাকিস্তান, পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এটিকে ১৯৭১ সালে ‘দি স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টি অব বাংলাদেশ- বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ’ নামকরণ করা হয়। ১৯২০ সাল থেকে বেঙ্গল রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ আমাদের পূর্ব বঙ্গে এল.এম.এফ; এম.এম.এফ কোর্স চালু করে। পরবর্তীতে বিশেষ কিছু কারণে এম.এম.এফ কোর্স বন্ধ হয়ে যায়, তবে এল.এম.এফ কোর্সটি ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) চালু ছিল। উল্লেখ্য, ১৯২০ সালের পূর্বে এই পূর্ব বঙ্গে চিকিৎসা বলতে যা ছিল তা বেশিরভাগ দেশজ কবিরাজ ও হেকিমী চিকিৎসা। অবশ্য ইংরেজরা ১৮২২ সালে কলকাতায় আধুনিক এলোপ্যাথিক চিকিৎসা বিদ্যায় সর্ব প্রথম 'নেটিভ মেডিকেল ইন্সটিটিউট' স্থাপন করলে সেখানে বাংলা ও বিহারের কিছু শিক্ষার্থী এলোপ্যাথিক এল.এম.এফ; এল.এম.পি সমমান কোর্স করার সুযোগ পেত। তারপর ১৮৩৫ সালে উপমহাদেশে সর্ব প্রথম 'কলকাতা মেডিকেল কলেজ' প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতা মেডিকেল কলেজে বাংলা ও বিহারের হাতে গোনা অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থী পড়াশুনার সুযোগ পেত। পাকিস্তান পিরিয়ড়ে পূর্ব বাংলার কিছু কিছু জায়গায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার প্রচলন শুরু হয়। সেই সাথে আস্তে আস্তে পূর্ব বাংলায় এলোপ্যাথিক চিকিৎসা বিদ্যার উন্নতি হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে সর্ব প্রথম ১৯৪৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে চিকিৎসা বিদ্যায় স্নাতক এম.বি.বি.এস ডিগ্রি, ১৯৬১ সালে দন্ত চিকিৎসা বিদ্যায় স্নাতক বি.ডি.এস ডিগ্রি চালু হয়। এই স্নাতক ডিগ্রি গুলো পরিচালিত হচ্ছে এদেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। পরবর্তীতে এদেশে চিকিৎসা বিদ্যায় ও দন্ত চিকিৎসা বিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি চালু হয়। সেই সাথে ১৯৫৭ সালের দিকে ব্রিটিশ- পাকিস্তান পিরিয়ডের এদেশের মধ্যম মানের এল.এম.এফ চিকিৎসকের কোর্স টি তৎকালীন সরকার বন্ধ করে দেয়। তবে, ঐ কোর্স বন্ধ করার পূর্বে তৎকালীন সরকার ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত স্যার সলিমুল্লাহ্ মেডিকেল কলেজে (প্রাক্তন ঢাকা মেডিকেল স্কুল) ব্রিটিশ-পাকিস্তান পিরিয়ডের মেডিকেল কাউন্সিল নিবন্ধিত (এল. এম. এফ; এম. এম. এফ) সার্টিফিকেট কোর্সধারী ডিপ্লোমা সমমান চিকিৎসকদের ২ বছর মেয়াদে কনডেন্সড্ এমবিবিএস কোর্স সাথে ১ বছর ইন্টার্নিশিপ করিয়ে প্রশাসন, জেলা ও মহুকুমা হাসপাতালে নিয়োগ প্রদান করে। পরবর্তীতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে এই চিকিৎসকরা অনেকেই মেডিকেল অধ্যাপকও হয়েছেন। একই ভাবে তৎকালীন ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ (এল. এম. এফ; এম. এম. এফ) সার্টিফিকেট কোর্সধারী ডিপ্লোমা সমমান চিকিৎসকগণ কনডেন্সড্ এমবিবিএস কোর্স করার সুযোগ পান। উল্লেখ্য, (এল. এম. এফ; এম. এম. এফ; এইচ.এ) সার্টিফিকেট কোর্সধারী ডিপ্লোমা সমমান চিকিৎসকগণ রাজ্য কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে সাব এ্যাসিসট্যান্ট সার্জন, সহকারী মেডিকেল অফিসার, মেডিকেল অফিসার, আবাসিক মেডিকেল অফিসার পদবিতে সরকারি চাকরি করতেন। এ সকল চিকিৎসকদের প্রত্যেকে তৎকালীন 'মেডিকেল কাউন্সিল' কর্তৃক নিবন্ধিত ছিলেন। ১৯৪৬ সালের পূর্বে বর্তমান বাংলাদেশে যখন স্নাতক এমবিবিএস ডিগ্রি কিংবা স্নাতক 'মেডিকেল কলেজ' প্রতিষ্ঠান কোনোটাই ছিল না, তখন 'মেডিকেল স্কুল' পাস এই (এল. এম. এফ; এম. এম. এফ, ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল পাস চিকিৎসক) সার্টিফিকেট কোর্সধারী ডিপ্লোমা সমমান চিকিৎসকগণ আবহমান গ্রাম বাংলা, পল্লী, শহর নির্বিশেষে সকল মানুষের সর্বোত্তম এলোপ্যাথিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছেন। রেফারেন্স বুক; মিডফোর্ড হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল স্কুল ইতিহাস ও ঐতিহ্য ১৮৫৮- ১৯৪৭। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিস, নেটিভ মেডিকেল ইন্সটিটিউট ও কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইতিহাস ও ঐতিহ্য ১৭৬৪-১৮৩৫ বুক।

    পর সমাচার, ১৯৭১ সালের পরে এই যুদ্ধ পীড়িত ও যুদ্ধাহত নব স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, অনেক গরীব, দুস্থ, অসহায় মানুষের সামান্য রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদানও সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেটা মনে করতে হলে, আমাদের সেই পূর্বের কথা স্মরণ করতে হবে যখন সামান্য কলেরা রোগে গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য হয়ে যেত, অসংখ্য মানুষ মারা যেত। যা তৎকালীন সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। তৎকালীন সময়ে সারা বাংলাদেশে এমবিবিএস চিকিৎসক ছিলেন মাত্র ৬ হাজার ৫ শত ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের মেডিকেল কাউন্সিল নিবন্ধিত এলএমএফ, এমএমএফ, ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল পাস চিকিৎসক ছিলেন মাত্র ৫ হাজার। তৎকালীন প্রায় ৭ সাত কোটি বাংলাদেশীকে মোট ১১ হাজার ৫ শত চিকিৎসক দিয়ে সুষ্ঠু ভাবে চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভবপর ছিলনা। ঠিক তখনি স্বল্প সময়ে সবার জন্য মৌলিক অধিকার চিকিৎসা সেবা প্রদান বাধ্যতামূলক করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৭৩-১৯৭৮ ইং মোতাবেক পূর্বেকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া এলএমএফ, এমএমএফ চিকিৎসকদের কোর্স কারিকুলামের কথা চিন্তা করে এমবিবিএস চিকিৎসকের বিকল্প চিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসা বিদ্যায় আন্তর্জাতিক মানের একটি চিকিৎসা বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্স অনুমোদন করিয়ে নিয়ে আসে। সেই মিড লেভেলের বিকল্প চিকিৎসকদের ইন সার্ভিস পদবি মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্ট (ক্যাডার) হবে এই প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। আপনারা জানেন, ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের এলএমএফ, এমএমএফ, হসপিটাল এ্যাসিসট্যান্ট, ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল পাস চিকিৎসক সমমান সার্টিফিকেটধারী চিকিৎসকগণ ভারতীয় উপমহাদেশে সাব এ্যাসিসট্যান্ট সার্জন, সহকারী মেডিকেল অফিসার, মেডিকেল অফিসার, আবাসিক মেডিকেল অফিসার ইন সার্ভিস পদবিতে চাকরি করতেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্বলিখিত দালিলিক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় উক্ত চিকিৎসা প্রশিক্ষণ সম্পন্নকারী মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্ট ক্যাডারগণ তিন বছর সরকারি চাকরি করার পর মেডিকেল কলেজে ডেপুটেশনে কনডেন্সড্ এমবিবিএস কোর্স করতে পারবেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্ট ক্যাডারগণদের জন্য নির্ধারিত কনডেন্সড্ এমবিবিএস কোর্স ৫১ বছর পরও বাস্তবায়ন হয় নাই। এটা সিরিয়াস ক্রাইম করা হয়েছে। যারা এই ক্রাইমের সাথে জড়িত তাদের প্রত্যেকের বিচার হওয়া উচিত। সকল ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসকদের প্রাণের দাবি, উচ্চতর শিক্ষায় সুযোগ সৃষ্টির লক্ষে ডিএমএফ ডিগ্রিধারী ডিপ্লোমা চিকিৎসকদের জন্য ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের ‘ঢাকা প্রকৌশলী ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ ডুয়েট এর ন্যায় একটি সরকারি মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস্) প্রতিষ্ঠানকে স্বতন্ত্র ‘পোস্ট বেসিক মেডিকেল কলেজ’ রূপান্তর করা হোক। জাতীয় ভাবে পরিচালিত এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় ডিএমএফ ডিপ্লোমা চিকিৎসকদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হোক। ডিপ্লোমা চিকিৎসকগণ স্বপ্ন দেখেন যে, তারা চিকিৎসা বিদ্যায় উচ্চশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা খাত কে জনগণের দোর-গোড়ায় পৌঁছে দেবেন, চিকিৎসা সেবা খাতকে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজড্ করবেন।

    প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রস্তাবনা মোতাবেক ১৯৭৬ সালে মেডিকেল প্রশিক্ষণ কোর্স চালুকরণের বদলে সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের মাধ্যমে এলএমএফ, এমএমএফ, ন্যাশনাল পাস চিকিৎসকদের কোর্সের ন্যায় মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস্) প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মেডিকেল ডিপ্লোমা কোর্স (ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টি-ডিএমএফ) পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। এই মেডিকেল ডিপ্লোমাধারীরা মেডিকেল প্র্যাকটিশনার-চিকিৎসক হিসেবে বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বিএমডিসি নিবন্ধিত হবেন পূর্বলিখিত দালিলিক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। সেই মোতাবেক মেডিকেল ডিপ্লোমাধারীরা ১৯৮০ সালের বিএমডিসি আইনের ১৪(২) ধারায় মেডিকেল প্র্যাকটিশনার-চিকিৎসক হিসেবে নিবন্ধিত হন। শুধু তাই নয়৷ মেডিকেল ডিপ্লোমাধারীরা যেহেতু চিকিৎসক তাই তাদের আরো প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় গভর্নমেন্ট ইন সার্ভিসে মেডিকেল এ্যাসিট্যান্ট পদবি প্রাপ্তরা সরকারি সার্ভিসের শুরুতেই উপসহকারী প্রকৌশলী- ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সমান সুযোগ সুবিধা পাবেন। ১২ বছর সন্তোষজনক চাকরি করার পর মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্টগণ পদোন্নতিতে ৯ম গ্রেডের মেডিকেল অফিসার (প্রথম শ্রেণি) প্রাপ্ত হবেন। যে পূর্বলিখিত দালিলিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেডিকেল ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা হয়েছে তা ৪৯ বছর পরও মেডিকেল ডিপ্লোমাধারীদের পদোন্নতিতে মেডিকেল অফিসার বাস্তবায়ন করা হয় নাই। এখানে একটি কমিউনিটির সাথে ওয়াদা দিয়ে সেই ওয়াদা বাস্তবায়ন করা হয় নাই। যে কারণে এই কমিউনিটি অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এখানে সিরিয়াস ক্রাইম করা হয়েছে মেডিকেল ডিপ্লোমাধারীদের সাথে। যারা এই ক্রাইমের সাথে জড়িত তাদের প্রত্যেককে বিচারের সম্মুখীন করা উচিত। পদোন্নতিতে যে মেডিকেল ডিপ্লোমাধারীদের মেডিকেল অফিসার (প্রথম শ্রেণির গেজেটেড অফিসার) হওয়ার কথা তারা চিকিৎসক নয় অন্য কিছু এটা বলার সুযোগ কোন আইনে নেই। মেডিকেল ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসকদের ইন সার্ভিস এন্ট্রি পদবি "মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্ট" চিকিৎসা পেশার সাথে বেমানান বিধায় ১৯৯৬ সাল মহামান্য রাষ্ট্রপতি গেজেট নোটিফিকেশন দ্বারা মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্টদের ইন সার্ভিস পদবি পরিবর্তন করে জনস্বার্থে "উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার" বাস্তবায়ন করেন।

    গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় অনুমোদিত, বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ কর্তৃক অধিভূক্ত, বিএমডিসি স্বীকৃত (ম্যাটস্) এর মাধ্যমে ১৯৭৬ সালে ‘ডিএমএফ’ ডিপ্লোমা চিকিৎসকতা পেশা কোর্স টি প্রথম যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ডিএমএফ ডিগ্রির এ্যাকাডেমিক কোর্স ৪ বছর মেয়াদী সাথে অতিরিক্ত ৬ মাসের ইন্টার্নশিপ রয়েছে। ১৭ টি সরকারি ম্যাটস্ ও প্রায় ২০০ টি বেসরকারি ম্যাটস্ ডিপ্লোমা চিকিৎসকের ‘ডিএমএফ’ ডিগ্রি কোর্স টি পরিচালনা করে আসছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৭ হাজার ডিপ্লোমা চিকিৎসক ‘উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার’ পদে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, উপ-হাসপাতাল সহ জেলা হাসপাতাল, স্বায়ত্তশাসিত চিকিৎসা কেন্দ্রে কর্মরত আছেন। এছাড়াও প্রায় ১৫ হাজার ডিপ্লোমা চিকিৎসক বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, দেশি-বিদেশি এনজিও-তে কর্মরত আছেন। বর্তমানে নতুন পাস করা প্রায় ৫০ হাজার ডিপ্লোমা চিকিৎসক বেকার আছেন, যাদেরকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রায় ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার হিসেবে পদায়ন করা হলে কমিউনিটির জনগণের চিকিৎসা সেবায় বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হবে বলে সাধারণ জনগণ মনে করেন। তখন কমিউনিটি ক্লিনিক সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য বিষয়ক রোল মডেল হিসেবে আরো দৃঢ় ভাবে উপস্থাপিত হবে। এখনই এ বিষয়ে সরকারের জরুরি ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

    ১৯৮০ সালের বিএমডিসি আইনের ধারা (২) এর ঞ, ড উপধারা অনুযায়ী নিবন্ধিত সকল ব্যক্তিকে চিকিৎসক বলা হয়েছে। উক্ত বিএমডিসি আইনের (ইংলিশ ভার্সন) Section (2) এর j, m Sub Section অনুযায়ী নিবন্ধিত সকল ব্যক্তিকে Medical Practitioner হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত বিএমডিসি আইনের ১৪(২) ধারা মোতাবেক ডিএমএফ ডিগ্রিধারীগণ Medical Practitioner-চিকিৎসক হিসেবে নিবন্ধিত।


    ✅ উল্লেখ্য, বাংলাদেশ শ্রম আইন- ২০০৬ (সংশোধিত) ২০১৮, The Allopathic System (prevention of misuse) Ordinance 1962, The Medical Practice Private Clinics and Laboratories (Regulation) Ordinance 1982, Vaccination Act 1880, The Medical Degrees Act 1916, The Medical Diplomas Act 1939, Acid Control Act 2002, The Mines Act 1923, The Public Servants (Retirement) Act 1974, The Bengal Medical Act 1914 ইত্যাদি সহ আরো কিছু আইনে Medical Practitioner, Physician, Doctor, চিকিৎসক এর যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে সেখানে বিএমডিসি নিবন্ধিত সকল ব্যক্তিগণদের বুঝানো হয়ে। স্পেসিফিক কোন ডিগ্রিধারীদের চিকিৎসক বুঝানো হয় নি। দেশের প্রচলিত সকল আইনে বিএমডিসি নিবন্ধিত সকল ব্যক্তিগণদের মেডিকেল প্র্যাকটিশনার-চিকিৎসক-ডাক্তার-ডক্টর বলা হয়েছে। স্পেসিফিক কোন ডিগ্রিপ্রাপ্তদের মেডিকেল প্র্যাকটিশনার-চিকিৎসক-ডাক্তার-ডক্টর বলা হয় নি।

    ১৯৮০ সালের বিএমডিসি আইন সংশোধন না করে নতুন করে বিএমডিসি'২০১০ আইন তৈরির সময় নিবন্ধিত একদল ব্যক্তিদের চিকিৎসক-ডাক্তার বলা হয়েছে নিবন্ধিত আরেক দল ব্যক্তিদের ষড়যন্ত্র করে মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্ট- চিকিৎসা সহকারী বানানো হয়েছে। এটা বেআইনী ও অসাংবিধানিক। যে কারণে ডিএমএফ ডিপ্লোমা চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ ডিপ্লোমা মেডিকেল এসোসিয়েশন বিডিএমএ এর পক্ষ থেকে বিএমডিসি'২০১০ আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মহামান্য হাইকোর্টে কয়েকটি মোকদ্দমা চলমান রয়েছে।


    ব্রিটিশ-ভারতীয় উপমহাদেশে যতগুলো মেডিকেল কাউন্সিল তৎকালীন সময়ে বিদ্যমান ছিল আর বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান রয়েছে সকল দেশের মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল কেবল মেডিকেল প্র্যাকটিশনার-চিকিৎসক-ডক্টর-ডাক্তার-ফিজিশিয়ানদের পেশাগত রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে, বর্তমানেও দিচ্ছে। চিকিৎসকদের বাইরে অন্য কোন পেশাজীবিদের মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল রেজিস্ট্রেশন দেয় নি, এখনো দেয় না। অতএব বিএমডিসি নিবন্ধিত ডিএমএফ ডিগ্রিধারীরা আইনানুগভাবে ব্রিটিশ-ভারতীয় উপমহাদেশের সকল দেশ সহ সারাবিশ্বে চিকিৎসক হিসেবে গণ্য হবেন। ব্রিটিশ-ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্গত স্বাধীন সকল দেশের বর্তমান মেডিকেল কাউন্সিল নিবন্ধিত সকল ব্যক্তিকে মেডিকেল প্র্যাকটিশনার- চিকিৎসক-ডাক্তার-ডক্টর-ফিজিশিয়ান হিসেবে চিকিৎসা সেবা কার্য পরিচালনার অনুমোদন দেয়। এসব মেডিকেল কাউন্সিল আইনে নিবন্ধিত কেউ ডাক্তার পদবি ব্যবহার করতে পারবেন আবার কেউ ডাক্তার পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না এরকম উদ্ভট শব্দ চয়ন নেই। মেডিকেল কাউন্সিল নিবন্ধিত সকল ব্যক্তিগণ মেডিকেল প্র্যাকটিশনার- চিকিৎসক-ডাক্তার-ডক্টর-ফিজিশিয়ান। কাজেই বিএমডিসি'২০১০ আইনের ধারা (২৯) এর এই উদ্ভট শব্দ চয়ন বেআইনী ও অসাংবিধানিক। এই (২৯) ধারার মাধ্যমে বিএমডিসি স্বীকৃত ও নিবন্ধিত প্রায় ১ লক্ষ ডিএমএফ ডিগ্রিধারী ডিপ্লোমা চিকিৎসকদের মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্ট বানানোর পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমতাবস্থায় (২৯) ধারা বাতিল কিংবা সংশোধন করা দরকার৷ অন্যথায় মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বিএমডিসি নিবন্ধিত পোস্ট গ্র্যাজুয়েটদের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পদবি, গ্র্যাজুয়েটদের ডাক্তার পদবি সেই সাথে ডিপ্লোমাধারীদের ডিপ্লোমা ডাক্তার পদবি ঘোষণা করে (২৯) ধারার বৈষম্য রোধ করা যেতে পারে। চিকিৎসক হিসেবে পেশাগত রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্তির ৫০ বছর পর মেডিকেল ডিপ্লোমাধারীদের ডিপ্লোমা ডাক্তার পদবি ঘোষণা না করে মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্ট পদবি ঘোষণা করা হলে ডিএমএফ ডিপ্লোমা ডাক্তারদের মধ্যে গণবিস্ফোরণ ঘটতে পারে। যার দরুণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা সেবা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে পারে। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মারাত্মক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। বিষয়টির আশু সমাধান অতীব জরুরী। 


    লেখক, ডা. এম. মিজানুর রহমান

    চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যবিদ, মেডিকোলিগ্যাল লইয়ার।