এমবিবিএস থাকতে ডিএমএফ চিকিৎসকের কি প্রয়োজন?
ডিএমএফ এবং এমবিবিএস এর কার্যপরিধি এক নয়। প্রত্যেকে সতন্ত্রভাবে এবং সম্বন্বিতভাবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেন। ডিএমএফদের নিয়োগ দেয়া হয় উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে হেলথ কমপ্লেক্সে অর্থাৎ একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাধরণ মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে।
গ্রামাঞ্চলে জরুরী ও প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা, নারী ও প্রসূতি সেবা, পরিবার পরিকল্পনা, ইপিআই ভ্যাকসিনেশন এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা ইত্যাদি বিষয়ে ডিএমএফ ডিগ্রিধারী ডিপ্লোমা চিকিৎসক বা, উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারগণ যে ভূমিকা পালন করেন, তা গ্রাজুয়েট চিকিৎসকের মাধ্যমে সম্ভব হয় না। (কেন সম্ভব নয়, নিম্নোক্ত আলোচনায় প্রাসঙ্গিক ভাবে বুঝতে পারবেন) এজন্য পৃথিবীব্যাপী মধ্যম স্তরের চিকিৎসা সেবা দানকারী প্রচলিত আছে, যারা এই জায়গায় ভুমিকা রাখেন। বাংলাদেশে যেমন উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার, তেমনি ডিএমএফ ডিপ্লোমার যোগ্যতার সমকক্ষ ডিগ্রিধারীরা বিভিন্ন দেশে যেমন ক্লিনিক্যাল অফিসার, ফিজিশিয়ান এসোসিয়েট, এ্যাসিসটেন্ট হেলথ অফিসার, মেডিকেল এ্যাসিসটেন্ট ইত্যাদি পদে কাজ করে থাকেন।
ডিএমএফ ডিগ্রিধারীরা এমবিবিএস এর প্রতিপক্ষ কি না?
বাংলাদেশে ডিএমএফ ডিগ্রিধারীরা ৪ বছর মেয়াদি মেডিকেল ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে, তারা তার অর্জিত জ্ঞানের লেভেল অনুযায়ী রোগের চিকিৎসা এবং রোগীর সেবা দান করে থাকেন। যে রোগ বা রোগী তার ডিপ্লোমা জ্ঞান বা বিএমডিসির আইনের বাইরে চলে যায়, সেসব রোগীদের রেফার করেন গ্রাজুয়েট চিকিৎসক বা এমবিবিএস ডাক্তারগণের নিকটে। সকল ধরনের রোগের চিকিৎসা যে শুধুমাত্র এমবিবিএস ডিগ্রীধারী দিতে পারবেন সেটাও ঠিক নয়। এমবিবিএস ডিগ্রীধারীদেরও জ্ঞান এবং আইনগত একটা নির্দিষ্ট পরিসীমা আছে, যে চিকিৎসা শুধুমাত্র এমবিবিএস ডিগ্রীধারীর আওতার বাইরে থাকবে সেসকল রোগের চিকিৎসা করবে পোষ্ট গ্রাজুয়েট ডাক্তারগণ। চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রাথমিক চিকিৎসা, জরুরী চিকিৎসা সেবা, লাইফ সেভিং, রেফারেল সিস্টেম ইত্যাদি ভাবে গ্রাজুয়েট চিকিৎসকের সেবাকে আরো দ্রুত ত্বরান্বিত করতে ভুমিকা রাখে এই ডিএমএফ ডিগ্রিধারীরা।
অর্থাৎ ডিপ্লোমা এবং এমবিবিএস, পোষ্ট গ্রাজুয়েট ডাক্তার সকলেই তার নির্দিষ্ট পরিধির মধ্যে থেকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। এক্ষেত্রে একজন, আরেকজনের বিকল্প ভাবাটা অমূলক। বরং প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এবং সম্বন্বিতভাবে মেডিকেল টিম হয়ে কাজ করলে সাধারণ মানুষের দ্রুত এবং মানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত হয়।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের প্রকৃত চিত্র বিবেচনায় ডিএমএফ চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
চলুন ধাপে ধাপে দেখা যাক
১. গ্রাজুয়েট চিকিৎসক সংখ্যা
দেশে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সংখ্যা এক লাখ ৭৯ হাজার ১৬০। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে বসবাসরত সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের জন্য চিকিৎসক রয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার ৫৭ জন। বিপরীতে গ্রামে ১১ কোটি ৩০ লাখ মানুষের জন্য চিকিৎসক রয়েছে মাত্র ৩৯ হাজার ১০৩ জন। এই হিসাবে শহরের ৩৯৩ জন মানুষের জন্য একজন চিকিৎসক, আর গ্রামের দুই হাজার ৮৮৯ জন মানুষের ভাগে মাত্র একজন চিকিৎসক রয়েছে।
২. গ্রামে চিকিৎসক থাকতে চান না।
গ্রামে গ্রাজুয়েট চিকিৎসক সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এবং গ্রামের হাসপাতালের প্রকৃত চিত্র জরিপের তুলনায় আরো নাজুক, কারণ গ্রামে এমবিবিএস চিকিৎসকরা থাকতে চান না।
৯৬% চিকিৎসক গ্রামে থাকতে সমস্যা দেখেন [প্রথম আলো - ০৯.০৪.২৪]
গ্রামে চিকিৎসক নেই, শহরে রোগীর চাপে হিমশিম [প্রথম আলো-৩.১২.২৩]
গ্রামে চিকিৎসক থাকতে না চাওয়ার পেছনে যেসব কারণ আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ। গ্রামাঞ্চলে বাস করে শহরে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ একটি অতিমাত্রায় দূরহ ব্যাপার। তাই পোষ্ট গ্রাজুয়েশন, বিসিএস পরীক্ষা, হাইয়ার ডিপ্লোমা ইত্যাদি প্রয়োজনে তাদের শহরমুখী হতেই হয়।
অপরদিকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে এই জায়গায় কাজ করে উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারগণ।
কেননা, তাদের পোস্টিং হয় শুধুমাত্র উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স, পরিবার পরিকল্পনা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। ফলে তাদের কর্মস্থল থেকে শহরমুখী হবার কোন প্রবণতা নেই। এবং অতিব দুঃখজনক ব্যাপার যে ডিএফএফ ডিগ্রিধারীদের যথাপযুক্ত উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ এই দেশে নেই। তাই তাদের পেশাগত জীবন পুরোটাই গ্রাম কেন্দ্রিক।
৩. গ্রামে চিকিৎসকের অনুপস্থিতি
হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকেন ৪৬% চিকিৎসক-কর্মকর্তা [ সমকাল- ১০.০২.২৪]
এমবিবিএস ডিগ্রী অর্জনের জন্য যে খরচ বহন করতে হয় তা বহন করা সাধারণত গ্রাম্য দরিদ্র সন্তানের জন্য সম্ভব হওয়া কঠিন হয়। প্রাইভেট মেডিকেলের খরচ বহন করা তো আকাশ কুসুম কল্পনা। তাই মেডিকেল পড়ুয়া বেশিরভাগই হয় শহরকেন্দ্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তাই তারা গ্রাম্য পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন না অনেকেই, যা শহরমুখী হবার আরেকটি কারণ। প্রাইভেট প্র্যাকটিস, অনিয়ম, তদারকির ঘাটতি ইত্যাদি কারণেই অনেক চিকিৎসক কর্মস্থলেও নিয়ম মাফিক উপস্থিত থাকেন না। ফলে গ্রামের মানুষ কাঙ্খিত চিকিৎসা সেবা থেকে বরাবরই বঞ্চিত হয়।
বেসরকারী ভাবে চিকিৎসা গ্রহণের অতি উচ্চ খরচ আমাদের কারো অজানা নয়, যা গ্রামীণ সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতার বাইরে। এই সব কারণেই, এমবিবিএস ডাক্তার থাকলেও উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের প্রয়োজনীয়তা থেকে যায়। তাদের উপস্থিতি স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমকে আরো সুসংগঠিত ও কার্যকর করতে সাহায্য করে।
গ্রাজুয়েট চিকিৎসক পর্যাপ্ত হয়ে গেলেও ডিএমএফ চিকিৎসকদের প্রয়োজন আছে। কেন? তা জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে স্বাস্থ্যখাতে তাদের ভূমিকা কি?
১. মানসম্মত উপযুক্ত প্রাথমিক চিকিৎসা
চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সের তাদের যে সিলেবাস কাভার করানো হয়, তা প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা সুনিশ্চিত করার জন্য শুধু যথেষ্টই নয়, বরং তার থেকেও বেশি। তাই তাদের ৭৩টা ঔষধ লেখার বৈধতা এবং চিকিৎসা জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দ্রুততর সময়ে মানসম্মত প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। ড্রাগ লিষ্ট আপডেট করে যা আরো বিস্তৃত করা সম্ভব। এছাড়াও মেডিকেল ইমার্জেন্সি শনাক্তকরণ, জরুরি চিকিৎসা, লাইভ সেভিং, সিপিআর, ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি তাদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
২. এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধ
ডিএমএফ দের কোর্স ক্যারিকুলাম অনুযায়ী তাদেরকে ১ বছর ফার্মাকোলজি এবং প্যাথলজি সাবজেক্ট পড়ানো হয়। এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সহ ফার্মাকোলজি, প্যাথলজির ব্যাসিক সকল কিছুই তাদের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। তাই এন্টিবায়োটিকের যত্রতত্র ব্যাবহার, রেজিস্ট্যান্স রোধে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যাতিত ইচ্ছেমতো মেডিসিন সেবনের ঝুঁকির ব্যাপারে রোগীদের সতর্ক এবং কাউন্সিলিং করার জন্য এই ডিএমএফ ডিগ্রিধারীরা একটি চমৎকার একটি সমাধান। কেননা যেসকল প্রত্যন্ত অঞ্চল এখনো গ্রাজুয়েট চিকিৎসকের আওতার বাইরে, সেসব অঞ্চলেও এই ডিপ্লোমাধারীরা যতেষ্ট বড়সড় প্রভাব বিস্তার করে আছে। কিন্তু নিয়োগের অভাবে এই ডিপ্লোমাধারীদের সেভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
৩. উন্নত রেফারেল সিস্টেম
যেসকল রোগীর জন্য গ্রাজুয়েট এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা প্রয়োজন তা বাছাই করে রেফারেল সিস্টেমে গ্রাজুয়েট চিকিৎসকের নিকট প্রেরণ করার এ কাজটি দ্রুততার সাথে করতে সক্ষম ডিএমএফ ডিগ্রিধারীরা।
৪. জরুরি চিকিৎসা প্রদান
গ্রাজুয়েট চিকিৎসক যে অঞ্চলে অপ্রতুল সেখানে জরুরী প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে দ্রুততর সময়ের মধ্যে বিশেষায়িত সেবা কেন্দ্রে প্রেরণ করা।
৫. স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতা
ডিএমএফ ডিগ্রিধারী উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের নিয়োগ দেয়া হয় উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে। একদম গ্রাম থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরামর্শ দেয়া তাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
৬. প্রসূতি সেবা প্রদান
গাইনী এবং অবস সাবজেক্ট তাদের ক্যারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত এবং ইন্টার্নশিপেও রয়েছে হাতে কলমে ট্রেনিং তাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাথমিক নারী স্বাস্থ্য সেবা প্রদান এবং প্রসবপূর্ব ও প্রসবপরবর্তী মানসম্মত সেবা প্রদানে তাদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
৭. প্রতিষেধক কার্যক্রম
ভ্যাকসিনেশন ও অন্যান্য প্রতিষেধক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা।
৮. স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারা প্রচার
খাদ্যাভ্যাস, স্বচ্ছতা, পরিবার পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা।
৯. স্বাস্থ্য তথ্য সংগ্রহ ও রিপোর্টিং
স্বাস্থ্য তথ্য সংগ্রহ ও সরকারী স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে নিয়মিত রিপোর্ট প্রদান করা।
১০. স্বাস্থ্য কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা
স্থানীয় কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম সুসমন্বিত রাখা এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহ নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
এসএসিএমও-রা সাধারণত সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্পের আওতায় কাজ করেন এবং তাদের কাজ এলাকার জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, ডিএমএফ এবং এমবিবিএস এই পেশা মুখোমুখি দাড় করানো কোন এক কুচক্রী মহলের উদ্দেশ্য প্রণোদিত কাজ। এই দুই পেশা কখনোই প্রতিপক্ষ নয়, কিংবা একে অপরের বিকল্প নয়। প্রত্যেকে সতন্ত্রভাবে এবং সম্বন্বিতভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অবদান রেখে চলেছে। উভয় পেশার প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে এখনো বিদ্যমান।
তবে উভয় পেশার ক্ষেত্রেই সংশোধন এবং যুগোপযোগী করা সুযোগ রয়েছে।
Post a Comment